শ্যামনগরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে ভাঙছে বেড়ীবাধ, বাড়ছে আতঙ্ক,নিঃস্ব হচ্ছে উপকুলীয় মানুষ

এস. এম. মিজানুর রহমান শ্যামনগর (সাতক্ষীরা) প্রতিনিধি : সাতক্ষীরার শ্যামনগরে খোলপেটুয়া নদী থেকে ড্রেজার ম্যাসিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ২৫/৩০জন অবৈধ বালু ব্যবসায়ী বাণিজ্যিকভাবে বিক্রয়ের জন্য উত্তলোনকৃত বালু নওয়াবেকী বাজার, মুন্সিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের পাশে বেশকিছু জায়গায় গুদামজাতের পাশাপাশি বিভিন্ন ঠিকাদার ও ব্যক্তির চাহিদামতো সরবরাহ করা হচ্ছে।

 

 

স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের নাকের ডগায় দীর্ঘদিন এভাবে বালু উত্তোলন চললেও কেউ ‘টুঁ’ শব্দটি পর্যন্ত করছে না। বারবার নদী ভাঙনের মুখেপড়া এলাকা থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে প্রশাসন এমনকি পাউবোর কতৃপক্ষ অজ্ঞাত কারণে নীরবতা পালন করছে। দুর্যোগপ্রবণ এলাকা থেকে বালু উত্তোলনের ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে ভাঙ্গন আতঙ্ক বাড়ছে। সরেজমিনে উপজেলার খোলপেটুয়া নদীতীরবর্তী বিড়ালাক্ষী, পাতাখালী, পাখিমারা, ৯ নং সোরা, গাবুরা জেলেখালী, এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মাঝ নদীতে একাধিক ড্রেজার মেশিন বসানো রয়েছে। ছোট ছোট কার্গো ও নৌকার মধ্যে বসানো ওই মেশিনের সহায়তায় নদীর গভীর থেকে বোরিং করে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। একই সময়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নেওয়া হচ্ছে।

 

 

জানা যায়, বহিরাগত ও স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী খুলনা এবং পাশের এলাকাগুলো থেকে ড্রেজার মেশিন আর কার্গোসহ ভাড়াটে শ্রমিক এনে নির্দিষ্ট অঙ্কের চুক্তিতে এসব বালু উত্তোলন করছে। বালু উত্তোলনের কাজে জড়িত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উত্তোলনসহ নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দিতে দূরত্বভেদে বালু ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতি ফুট চার থেকে ছয় টাকা দিচ্ছে। পরে ওই বালু ফুটপ্রতি আট থেকে ১৪ টাকায় বিক্রি করছে। বালু ব্যবসায়ীদের দেখিয়ে দেওয়া অংশ থেকে তারা ‘হুকুমের গোলাম’ হিসেবে বালু উঠিয়ে দিচ্ছে বলেও তাদের দাবি। স্থানীয়দের দাবি, ভাঙনকবলিত এলাকা হওয়ায় মানুষের দৃষ্টি এড়াতে রাতে বালু উত্তোলন করছে সংশ্নিষ্টরা। স্থানীয় তহশিল অফিস, ঊর্ধ্বতন প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিরা অজ্ঞাত কারণে চুপ থাকায় মাসের পর মাস তারা বালু উত্তোলন অব্যাহত রেখেছে। স্থানীয়রা জানান, বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িতরা এলাকায় প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের কারও নাম কেউ মুখে আনতে সাহষ পাচ্ছে না।

 

 

বিড়ালাক্ষী গ্রামের আলমগীর হোসেন ও সামছুর রহমান জানান, গত এক যুগে অন্তত আটবার তাদের বসতবাড়ি সংলগ্ন উপকূল রক্ষা বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা পাবিত হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন জানান, নওয়াবেকীর ফারুক, এবং মুন্সিগঞ্জের ফেরদাউস হোসেন বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত। ভাড়াটে শ্রমিক দিয়ে নদী থেকে বালু উত্তোলনের পর তারা নিজেদের আড়তে গুদামজাতের পাশাপাশি উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তে তা সরবরাহ করছে।

 

তারা আরও জানান, ফারুক, জাহাঙ্গীরসহ কিছু ব্যবসায়ী একাধিক কার্গো, ড্রেজার মেশিনসহ নিজস্ব সরঞ্জাম দিয়ে লাগাতার খোলপেটুয়া নদী থেকে দীর্ঘমেয়াদে বালু উত্তোলন করছে। জনপ্রতিনিধিসহ জনপ্রশাসনকে নানাভাবে ‘ম্যানেজ’ করে তারা দীর্ঘদিন ধরে ভাঙন স্থান থেকে বাধাহীন বালু উত্তোলনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলেও তাদের দাবি। বালু উত্তোলনের বিষয়ে প্রধান অভিযুক্ত মুন্সিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বালু আড়তের মালিক ফেরদাউস হোসেন জানান, তিনি নিজে বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত নন। যারা উত্তোলন করে তাদের থেকে তিনি কিনে নিয়ে খুচরা বিক্রি করেন। কোথা থেকে আর কীভাবে তারা উত্তোলন করছে তা তার জানা নেই। বালু উত্তোলনের কাজে ব্যবহৃত কার্গোসহ যাবতীয় সরঞ্জাম নিজেরা নিশ্চিত করে।

 

নওয়াবেকীর ফারুক হোসেন জানান, সাতক্ষীরার এক ব্যবসায়ী ইজারা নেওয়া খোলপেটুয়া নদীর চর থেকে তাকে বালু উত্তালনের কাজ দিয়েছে। বালু উত্তোলনের কাজের সঙ্গে জড়িত কার্গো মালিক কালিকাপুর গ্রামের হাবিবুর রহমান বলেন, প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। তবে দূরের বালুমহালের অনুমতি থাকলেও যত্রতত্র বোরিং করে বালু উত্তোলন করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। তবে স্থানীয়দের দাবি, সাতক্ষীরার আশাশুনির চর বালুমহাল ইজারা ঘোষণা থাকার সত্বেও বেশি মুনাফার লোভে প্রভাবশালীরা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ভাঙনকবলিত নদী থেকে বালু উত্তোলন করছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের শেখানো বুলি আওড়িয়ে এসব ব্যবসায়ী ভাঙনকবলিত এলাকার বালু মহালের বলে চালিয়ে দিচ্ছে।

 

এ বিষয়ে পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আব্দুল হালিম জানান, নদীভাঙনের ফলে প্রতি বছর শ্যামনগরের উপকূলীয় এলাকার অসংখ্য পরিবার গৃহহীন হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। তারপরও নদীভাঙন কবলিত এলাকা থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ করা না হলে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি উপকূল রক্ষা বাঁধ কোনোভাবেই টিকবে না। শ্যামনগর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ শহীদুল্লাহ বলেন, নদীর চর থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়টি তাদের জানা ছিল না। এ নিয়ে তাদের কেউ অবহিত করেনি। এমনটি হলে পাহারার ব্যবস্থা করা হবে। জড়িতদের ধরতে পারলে আইনের আওতায় আনা হবে।