শ্যামনগরে অবৈধ প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ছড়াছড়ি প্রশাসন নিরব কেনো

এস এম মিজানুর রহমান শ্যামনগর (সাতক্ষীরা) প্রতিনিধি : সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলায় বেসরকারি পর্যায়ে স্থাপিত ক্লিনিক, ডেন্টাল ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি নিয়ন্ত্রণহীন ও ফ্লিমস্টাইলে চলছে। প্রতিনিয়ত সাধারন মানুষকে জিম্মি করে আদায় করছে হাজার হাজার টাকা। স্বাস্থ্য খাতে এসব লাগামহীন দুর্নীতি ও অনিয়ম চললেও যেন দেখার কেউ নেই। সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন বেসরকারী ক্লিনিক ও হাসপাতাল গুলোতে মানুষ স্বাস্থ্য সম্মত চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে কিনা বা হয়রানির শিকার হচ্ছে কিনা তা দেখার সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও অভিযোগ রয়েছে মাসোহারা নিয়েই তিনি সব কিছু না দেখার ভান করছেন।

 

 

সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য-চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেওয়ার নামে গ্রামে-গঞ্জে, হাট-বাজারে এবং শহরের অলিগলি, পাড়া-মহল্লায় ব্যাঙের ছাতার মতো ছোট-বড় অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠছে। এর অধিকাংশই অবৈধ এবং লাইসেন্স না থাকলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হচ্ছে না তেমন কোনো পদক্ষেপ।
শ্যামনগর উপজেলায় ক্লিনিক, ডেন্টাল ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি রয়েছে ৩৫টি। এ উপজেলায় রিডা প্রাইভেট হাসপাতাল, সেবা নাসিং হোম, নগর প্রাইভেট হাসপাতাল, ফারনান্দ নবরে প্রাইভেট হাসপাতাল, ফয়সাল আমিন সার্জিক্যাল ক্লিনিক, সুন্দরবন ক্লিনিকি, সেবা নার্সিং হোম, শামিমা ক্লিনিক, পল্লী প্রাইভেট হাসপাতাল, এম, আলি ক্লিনিক, সুন্দরবন এপোলো হাসপাতাল, কাশিমাড়ী ডায়নস্টিক সেন্টার, গরীবের হাসপাতাল, ছাড়াও অবৈধভাবে চিকিৎসা কেন্দ্রের নামে বিপুল সংখ্যক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ৫/৬টি ক্লিনিকের ২০১৯-২০ অর্থ বছরের জন্য অনুমোদন থাকলেও বাকীদের একেবারেই কোন অনুমোদন নেই বলে শ্যামনগর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জানান।

 

 

গত কয়েক বছরে বিপুল সংখ্যক ক্লিনিক ও ডেন্টাল ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি স্থাপিত হলেও এগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেই। কয়েক দশক পূর্বের মেডিকেল প্রাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ রেগুলেশন অর্ডিন্যান্স ১৯৮২ এর ভিত্তিতে এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে।

 

 

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জনগনের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১ পাস করে। কিন্তু কিছু দুর্নীতিবাজের কারণে স্বাস্থ্যনীতির সঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে না। শ্যামনগরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ক্লিনিক ও ডেন্টাল ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরিগুলো নিছক বাণিজ্যকেন্দ্র। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই নিয়ম-কানুনের বালাই নেই। যে কোনো ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি স্থাপন করতে হলে ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট, ইনকাম ট্যাক্স (টিআইএন) ছাড়পত্র, প্রতিষ্ঠানের শয্যাসংখ্যা অনুসারে প্রকার, বর্গফুট অনুসারে প্রতিষ্ঠানের পরিমাণ, ইনডোর, আউটডোর ও ভৌত সুবিধাদি, জারুরি বিভাগ, ওটি, ওয়াশরুম, লেবার রুম, অপেক্ষাকক্ষ, অফিস কক্ষ, প্রশন্ত সিঁড়ি, জেনারেটর, পোস্ট অপারেটিভ রুম, ইন্সট্রুমেন্ট রুম, অভ্যর্থনা কক্ষ, স্ট্যাবিলাইজার, চেঞ্জিং রুম, নার্সদের ডিউটি কক্ষ, অস্ত্রোপচার কক্ষের সুবিধা (শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত), ওটি টেবিল, সাকার মেশিন, জরুরি ওষুধের ট্রে, অক্সিজেন, ওটি লাইট, অ্যানেসথেসিয়া মেশিন, ডায়াথার্মি মেশিন, রানিং ওয়াটার, আইপিএস, যন্ত্রপাতির পূর্ণাঙ্গ তালিকা, সর্বক্ষণিক ডাক্তার-নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের নাম-ঠিকানা, যোগ্যতার সনদপত্র, নিয়োগপত্র, জরুরি অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্রপাতি ও ওষুধ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও অ্যাম্বুলেন্স থাকতে হবে।

 

 

এ ছাড়া প্রতিটি ক্লিনিকে সার্বখনিক একজন করে এমবিবিএস ডাক্তার ও তিনজন করে ডিপ্লমা নার্স থাকতে হবে অথচ শুধুমাত্র মডার্ণ ক্লিনিকি, রিডা প্রাইভেট ও সুন্দরবন এ্যাপোলো হাসপাতালে ১ জন করে ডাক্তার থাকলেও কোনো ডিপ্লমা নার্স নেই। প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি স্থাপনের জন্য একইভাবে নির্ধারিত নিয়মাবলী পালন করা অত্যাবশ্যক। এসব বিষয় নিশ্চিত করে বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালিত এসব ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরিগুলোর জবাবদিহিতা, মাননিয়ন্ত্রণ ও জনগণের ক্রয়সীমার মধ্যে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণই হবে বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রদানের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু শ্যামনগরের বহু প্রতিষ্ঠান নিয়ম- নীতির তোয়াক্কা না করে সেবাদানের প্রতিশ্রæতি দিয়ে লোক ঠকাচ্ছে। বৈধ ও অবৈধ ভাবে গজিয়ে ওঠা
প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশতেই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, প্রশিক্ষিত ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়, টেকনিশিয়ান , হাইড্রলিক টেবিল, অত্যাধিনিক বাল্ব এবং যন্ত্রপাতি নেই। যাচাই-বাছাই ছাড়া এ ধরনের প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ফলে সাধারণ রোগীরা চরমভাবে বিভ্রান্ত হচ্ছেন।

 

 

সুচিকিৎসার পরিবর্তে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে পয়সা খরচ করে চিকিৎসা নিতে গিয়ে কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে গিয়ে নিছক অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছে। একই ডাক্তারের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে অনেকগুলো ক্লিনিকে। শ্যামনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবার সার্বিক উন্নতি এবং সকল প্রকার পরীক্ষা নিরীক্ষার সুযোগ থাকলেও অভিযোগ রয়েছে, সেবা নিতে আসা অনেক রোগীকে ভুল বুঝিয়ে অথবা পরীক্ষার রিপোর্ট ভালো হয় না বলে বাইরে পাঠাচ্ছেন কিছু অসৎ ডাক্তার। বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য যত্রতত্র ফেলার কারণে তা জনস্বাস্থ্যের প্রতি মারাতœক হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

 

 

শ্যামনগর উপজেলা কোন ক্লিনিকে ময়লা আবর্জনা অপসারনের কোন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এদিকে ক্লিনিকগুলোতে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি ও অস্ত্রোপাচার বাবদ রোগীদের কাছ থেকে ইচ্ছে মাফিক অর্থ আদায় করা হচ্ছে। আবার বিধি অনুযায়ী, শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান রক্ত সঞ্চালন করতে পারবে না। কিন্তু এ আইন মানছে না কোন প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে আইন অমান্য করে ক্লিনিকে রক্তদান করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্লিনিকের মালিকানার সঙ্গে জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক নেতারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। তারাই প্রভাব খাটিয়ে প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নেন।

 

 

তাদের মধ্যে কেউ সদিচ্ছা নিয়ে ব্যবসা করেন, আবার কেউ দ্রæত বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হতে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ক্লিনিক চালান।এ ব্যাপারে শ্যামনগর মডার্ণ ক্লিনিকের পরিচালক তপন কুমার বিশ্বাসের সাথে কথা বললে তিনি জানান, নবায়নের জন্য আবেদন জমা দেওয়া হয়েছে অথচ নবায়ন এখনও পাইনি। সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. সাফায়েত হোসেন স্বাস্থ্য পরিসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোতে অনিয়ম হচ্ছে বলে স্বীকার করেন। তিনি জানান, জেলার যে সব ক্লিনিক ও ডেন্টাল ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি অবৈধ সেগুলোর তালিকা করে কয়েক বার জেলা প্রশাসককে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

 

 

তিনি আরও বলেন, এসব ক্লিনিক যখন খোলা হয় তখন এর মান যাচাই করা হয়। সে সময় মান ঠিক থাকলেও পরে মান নিম্নগামী হতে থাকে। যেসব ক্লিনিকে সর্বক্ষণিক ডাক্তার বা নার্স থাকে না সেগুলো আবার কীসের ক্লিনিক ? সেগুলো বন্ধ করে দেয়া উচিৎ। তবে বন্ধ করার ক্ষমতা আমাদের হাতে না, প্রশাসনের হাতে। শ্যামনগর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার জিয়াউর রহমান বলেন, যেসব ক্লিনিকে অনিয়ম রয়েছে তার বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।