স্পোর্টস: শেষ ওভারে প্রয়োজন ১৮ রান। দাসুন শানাকার প্রথম বলে ছক্কা মারলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। বরিশালের সমর্থকদের গর্জনে কেঁপে উঠল গ্যালারি। পরের বলে এলো সিঙ্গেল। এবার শোয়েব মালিকের পালা। সময়ের দাবি মিটিয়ে উত্তাল তার ব্যাটও। বোলারের মাথার ওপর দিয়ে বাউন্ডারির পর চোখধাঁধানো শটে ছক্কায় ওড়ালেন এক্সট্রা কাভার দিয়ে। পরের বলেই ওয়াইড। রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে বরিশালের আনন্দময় সমাপ্তি। বিপিএলের নাটকীয় ম্যাচে শনিবার খুলনা টাইগার্সকে ৫ উইকেটে হারাল ফরচুন বরিশাল। সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ১৫৬ রানের লক্ষ্য দুই বল বাকি থাকতে ছুঁয়ে ফেলল তারা। কয়েক ম্যাচ ধরেই শেষ দিকে ঝড় তোলা মিরাজ এ দিন খেলেন ১৫ বলে ৩১ রানের ইনিংস। মালিকের ব্যাট থেকে আসে ২৫ বলে ৪১ রান। এর আগে বল হাতে ২ উইকেট নেন পাকিস্তানের অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার। টানা চার জয়ের পর এবারের আসরে খুলনার প্রথম হার এটি। ছয় ম্যাচে বরিশাল পেল তৃতীয় জয়। বল হাতে শেষ ৪ ওভারে ৬৭ রান দেওয়া বরিশাল ব্যাটিংয়ে নেমেও শেষ দিকে পড়ে যায় একই রকম চ্যালেঞ্জে। একশ পেরিয়েই ৫ উইকেট হারানো বরিশালের শেষ ৪ ওভারে প্রয়োজন পড়ে ৫৪ রানের। ২৩ বলে ৫৫ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে ২সেই চ্যালেঞ্জ জিতে যান মিরাজ ও মালিক। দুজনই নিজেদের ইনিংসে মেরেছেন ১টি চারের সঙ্গে ৩টি করে ছক্কা। শেষের ঝড়টা শুরু করেন মূলত মিরাজ। ক্রিজে গিয়ে তৃতীয় বলে মোহাম্মদ ওয়াসিম জুনিয়রকে ছক্কা মারা এই অলরাউন্ডার পরে জীবন পান ১৩ রানে। ডিপ স্কয়ার লেগে ক্যাচ ছাড়েন মাহমুদুল হাসান জয়। এর চড়া মূল্যই দিলো খুলনা। জরুরি পারিবারিক কারণে ঢাকা পর্বের শেষ ম্যাচ খেলে দুবাই চলে যাওয়া মালিক এই ম্যাচের আগে আবার যোগ দেন দলের সঙ্গে। ফেরার ম্যাচটি তিনি রাঙালেন ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্সে। রান তাড়ায় শুরুতে খুব মসৃণ ছিল না বরিশালের পথচলা। ইনিংসের দ্বিতীয় বলে নাসুম আহমেদকে রিভার্স সুইপে চার মেরে যদিও আগ্রাসনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তামিম ইকবাল। কিন্তু এটি আর পূর্ণতা পায়নি পরের দিকে। দ্বিতীয় ওভারে নাহিদুল ইসলামের ড্রিফট করে বেরিয়ে যাওয়া ডেলিভারি ক্রিজ ছেড়ে তেড়েফুঁড়ে মারতে গিয়ে স্টাম্পড হন আহমেদ শেহজাদ। ফর্মে থাকা ব্যাটসম্যান এবার রানই করতে পারেননি। স্পিনারদের এলোমেলো করে দিতে তামিমের মতেই সুইপ আর রিভার্স সুইপের পথে হাঁটেন তিন নম্বরে নামা সৌম্য সরকার। চতুর্থ ওভারে নাহিদুলের বলে ছক্কা মারেন তামিম। চতুর্থ বলে রিভার্স করে চার মারেন সৌম্য। পরের বলে বাউন্ডারি আসে প্রথাগত সুইপ শটে। এরপর ক্রমেই মন্থর হতে থাকে রানের চাকা। পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে ফাহিম আশরাফের বলে ক্যাচ দেন ২০ রান করা তামিম। ১৩ রানে সহজতম এক ক্যাচ দিয়েও পারভেজ হোসেন ইমনের কাছে জীবন পাওয়া সৌম্য পরে যোগ করতে পারেন আর কেবল ১৩ রান। তাকেও থামান ফাহিম। দলের চাহিদা মিটিয়ে রানের গতি বাড়াতে পারেননি মুশফিকুর রহিম। চতুর্দশ ওভারে ২৫ বলে ২৭ রান করে ফেরেন মুশফিক। এক ওভার পর একই পথ ধরেন ৯ বলে ৪ রান করা মাহমুদউল্লাহ। মালিকও তখনও পর্যন্ত ছিলেন খানিকটা মন্থর। ওভারপ্রতি ১৩ রানের বেশি চাহিদায় সাত নম্বরে নামেন মিরাজ। তখন ১৭ বলে ১৯ রানে খেলছিলেন মালিক। পরের দুই ওভারে একটি করে বাউন্ডারি মারেন মিরাজ। মালিক তখনও যেন খোলসে বন্দী। ১৯তম ওভারে ওয়াসিমের ফুল টসে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট দিয়ে ছক্কায় ওড়ান মিরাজ। শেষ বলে আরেকটি ফুল টস ডেলিভারি ক্লাব হাউজের দোতলায় পাঠান মালিক। শেষ দুই ওভারে ৩৭ রানের সমীকরণ তখন নেমে আসে ৬ বলে ১৮ রানে। এরপর শানাকার বলে শেষের কাজ সারেন মিরাজ ও মালিক। ম্যাচের প্রথমভাগে স্পিন সহায়ক উইকেটে খুলনাকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় বরিশাল। আগের ম্যাচে সাইড স্ট্রেইনে মাঠ ছেড়ে যাওয়া বিস্ফোরক ওপেনার এভিন লুইসকে এদিন পায়নি খুলনা। তার বদলে চলতি আসরে প্রথমবার ম্যাচ খেলার সুযোগ পান পারভেজ। ইনিংসের তৃতীয় ওভারে আকিফ জাভেদের অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের বল স্কুপ করে স্টাম্পে টেনে আনে এনামুল হক। পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে নিজের ভুলে রান আউট হন হাবিবুর রহমান। এরপর মাহমুদুল হাসান জয়কে নিয়ে চাপ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন পারভেজ। নবম ওভারে শোয়েব মালিকের বলে বাঁহাতি ওপেনার মারেন ম্যাচের প্রথম ছক্কা। বেশি দূর অবশ্য যেতে পারেননি। এক বল পর মালিকের গতি কমিয়ে দেওয়া ডেলিভারি কিছুটা নিচুও হয়ে যায়। ভুল লাইনে খেলে এলবিডব্লিউ হন ৪ চার ও ১ ছক্কায় ২৪ বলে ৩৩ রান করা পারভেজ।পরের বলে আলতো শটে মেহেদী হাসান মিরাজের হাতে ক্যাচ দেন আফিফ হোসেন। বরিশালের বিপদ আরও বাড়ে তাইজুল ইসলামের বলে জয় ও দাসুন শানাকা অল্পেই ফিরে গেলে। ১৩ রান করতে ১৯ বল খেলেন জয়। ভুল লাইনে খেলে বোল্ড হওয়া শানাকা ১৩ বলে করেন ৬ রান। ¯্রফে ৭৮ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে তখন কঠিন বিপদে বরিশাল। রান রেটও নেমে যায় ছয়ের নিচে। এরপর নাহিদুল ইসলামও অল্পে ফিরে গেলে জুটি বাধেন মোহাম্মদ নাওয়াজ ও ফাহিম আশরাফ। শেষ ৪ ওভারে তা-ব চালিয়ে তারা দুজন মিলে যোগ করেন ৬৭ রান। সপ্তদশ ওভারে আকিফ জাভেদকে জোরা চার মারেন ফাহিম। শেষ তিন ওভারের প্রতিটি থেকে আসে ১৮ রান করে। মোহাম্মদ ইমরানের ওভারে আসে ৩ চার ও ১ ছক্কা। ১৯তম ওভারে প্রথমবার বল দেওয়া হয় মাহমুদউল্লাহর হাতে। তাকে জোড়া ছক্কা মারেন নাওয়াজ। শেষ ওভারে খালেদ আহমেদকেও দুই ছক্কায় ওড়ান নাওয়াজ। ইনিংসের শেষ বলে রান আউট হওয়া ফাহিম ৫ চার ও ১ ছক্কায় ১৩ বলে করেন ৩২ রান। নাওয়াজ অপরাজিত থাকেন ৪ ছক্কায় ২৩ বলে ৩৮ রান করে। ১৬ ওভার শেষে ৭ উইকেটে ৮৮ রানে থাকা দল শেষের ঝড়ে পেরিয়ে যায় দেড়শ। তখন কে ভাবতে পেরেছিল, শেষে ঝড় তুলেই তাদেরকে পেরিয়ে যাবে বরিশাল!
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
খুলনা টাইগার্স: ২০ ওভারে ১৫৫/৮ (এনামুল ১২, পারভেজ ৩৩, হাবিবুর ২, জয় ১৩, আফিফ ০, শানাকা ৬, নাওয়াজ ৩৮*, নাহিদুল ৫, ফাহিম ৩২; ইমরান ৩-০-২৫-১, মিরাজ ৪-০-২২-০, আকিফ ৩-০-২৭-১, মালিক ৪-০-২৪-২, খালেদ ২-০-২৬-০, তাইজুল ৩-০-৭-২, মাহমুদউল্লাহ ১-০-১৮-০)
ফরচুন বরিশাল: ১৯.৪ ওভারে ১৫৬/৫ (তামিম ২০, শেহজাদ ০, সৌম্য ২৬, মুশফিক ২৭, মালিক ৪১*, মাহমুদউল্লাহ ৪, মিরাজ ৩১*; নাসুম ৪-০-২৪-১, নাহিদুল ৩-০-৩০-১, ওয়াসিম ৪-০-৩৬-০, ফাহিম ৪-০-১৮-৩, নাওয়াজ ৩-০-২৩-০, শানাকা ১.৪-০-২৪-০)
ফল: ফরচুন বরিশাল ৫ উইকেটে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: শোয়েব মালিক
https://www.kaabait.com