সৈয়দ শওকত হোসেন,,বাগেরহাট : আধুনিক সমাজে একটি পিছিয়ে পড়া একটি যাযাবর জনগোষ্ঠীর নাম হচ্ছে বেদে সম্প্রদায়। পথে পথেই যাদের কেটে যায় পুরোটা জীবন। শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপদ বাসস্থান তাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এই সস্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিশুদের বেড়ে ওঠাও যেন বিভীষিকাময়। কিন্তু আধুনিক সমাজের সাথে এগিয়ে চলতে এদের অনেকেই পেশা পরিবর্তন করে সমাজের মূলধারায় ফিরতে চায়।
তাদের শিশুরাও স্বপ্ন দেখে পরিবর্তনের, হতে চায় চিকিৎসক ও শিক্ষক। তরে প্রয়োজনীয় সরকারি সুযোগ সুবিধার অভাবে কোথাও স্থায়ী হতে পারছে না তারা। তাদের অভিযোগ কেউ তাদের খোঁজও নেয় না। পায় না কোন ধরনের সরকারি সুযোগ সুবিধা। সরজমিনে বাগেরহাটের ফকিরহাটের কাটাখালি ও সদর উপজেলার মুনিগঞ্জ অস্থায়ী বেদে পল্লীতে গিয়ে কথা হয় সেখানকার বাসিন্দাদের সাথে। তারা জানান, একটা সময় ছিলো যখন বেদে সস্প্রদায়ের লোকেরা উপকূলীয় এলাকা গুলোতে নৌ বহরে চলাচল করতো। তবে সে সব এখন অতীত হতে চলেছে। অধিকাংশ বেদেরা এখন নৌকা বাদ দিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় এক থেকে দুই মাস অস্থায়ী ভাবে বসবাস করছে। বর্তমানে বাগেরহাট সদর, ফকিরহাট ও মোল্লারহাট উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করছে একাধিক বেদে বহর। এসব বহরের লোকেরা পলিথিনের অস্থায়ী ঘর বানিয়ে বসবাস করছে। এদের অনেকেই পেশা পরিবর্তন করে এই যাযাবর জীবন বাদ দিয়ে সমাজে স্বাভাবিক ভাবে বসবাস করতে চায়। বাগেরহাটে বসবাস করা অনেকেই ভাড়া বাসায় ও জমি কিনে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করলেও কোন ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ার সেটাও হয়ে উঠছে না বলে অভিযোগ তাদের।
কাটাখালি বেদে পল্লীর সরদার ইসরাফিল হাওলাদার বলেন, দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে এই কাটাখালি বেদে পল্লীতে আমি বসবাস করি। আমাদের এখানে ২০টি বেদে ঘর রয়েছে। এছাড়া আরও ৫০টি অস্থায়ী ঘর এখানেন ছিলো, যারা প্রায় এক মাস আগে চলে গেছে। আমি ফকিরহাটের পিলজঙ্গ ইউনিয়নের বাসিন্দা। আমার জাতীয় পরিচয়পত্র আছে। খুব কষ্ট করে মেম্বার ও চেয়ারম্যানের কাছে বারবার ধরনা দিয়ে আমি এই ইউনিয়নের বাসিন্দা হয়েছি। তবে আমি বাসিন্দা হলেও সরকারি কোন সুযোগ সুবিধা পাইনি। আমার মত অনেকেই আছে যারা দীর্ঘদিন এখানে বসবাসের ফলে এই ইউনিয়নের বাসিন্দা হয়েছেন। তবে আমরা কেউই সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা পাই না কখনও। আমরা তো সবাই ভূমিহীন সরকার তো ভূমিহীনদের জন্য ঘর এবং জমির ব্যবস্থা করেছে। আমরা এমনই হতভাগ্য সম্প্রদায় যারা সরকারি ঘর কিংবা জমি কিছুই পায়নি। আমাদের এখন আর আগের মতন ইনকাম নাই। তাই অনেক পরিবারই তাদের বাপ-দাদার পেশা পরিবর্তন করেছেন। আমাদের অনেকেই এখন সমাজের মূলধারায় ফেরার জন্য সংগ্রাম করছেন।একই পল্লীর বাসিন্দা আলেয়া বেগম বলেন, দীর্ঘ ২০ বছর ধরে এই এলাকায় বসবাস করছি। আমরা বেদে সম্প্রদায়ের লোকজনের মূল পেশা হচ্ছে সাপ ধরা, সাপের খেলা, শিঙ্গা লাগানোসহ বিভিন্ন কবিরাজি চিকিৎসা। তবে মানুষ এখন আমাদের চিকিৎসা সেবা নিতে চায় না। এ কারণে আগের মতন আয় রোজগারও নেই। আমাদের অনেকেই এখন পেশা পরিবর্তন করেছেন। এই যাযাবর জীবন বাদ দিয়ে আমিও পরিবার নিয়ে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করছি।
একই পল্লীর ১০ বছরের শিশু তাবাসসুম খাতুম বলেন, পলিথিনের ঝুপড়ি ঘরে থাকতে আমার ভালো লাগেনা। আমি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়াশোনা করি। বড় হয়ে আমি ডাক্তার হতে চাই। একই পল্লীর আরেক শিশু বরকতুল বলেন, আমিও তৃতীয় শ্রেণীতে পড়াশুনা করি। আমি বড় হয়ে শিক্ষক হতে চাই।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাঃ খালিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমান সরকার সমাজের সকল জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। এর আওতায় বেদে সম্প্রদায়সহ অন্যান্য যে জনগোষ্ঠী আছে তাদের নিয়েও সরকার কাজ করছে। এদের মধ্যে বিশেষ করে বেদে সম্প্রদায় এর জন্য সরকারের সামাজিক যে নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে এর আওতায় তাদের বিভিন্ন কাজের উপর দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়া সম্ভব। সে ক্ষেত্রে তাদের আমাদের কাছে আসতে হবে এবং সমস্যাগুলো বলতে হবে। এছাড়া আমি নিজেও খোঁজখবর নিব, যারা ইতিমধ্যে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করছেন বা বাসিন্দা হয়েছেন তাদের বিষয়টি বিবেচনা করে সরকারি জমিতে ঘর এবং জমির বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করা হবে। এছাড়া অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত এ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে সরকারের পাশাপাশি সমাজের সকলের এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।