স্পোর্টস: আইপিএলের সৌজন্যে পরিচিতি পেতে সময় লাগেনি তার। ব্যাটিং প্রতিভায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে আসছেন তো বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই। তবে প্রত্যেক ক্রিকেটারের স্বপ্নের জায়গা জাতীয় দল, সেখানে লম্বা রেসের ঘোড়া হতে পারেন কিনা, সেটাই ছিল মূল আলোচনা। জীবন যুদ্ধে প্রতিনিয়ত কঠিন পরীক্ষা দেওয়া যশস্বী জয়সওয়াল এখানেও উত্তীর্ণ। শুধু সংক্ষিপ্ত ফরম্যাট নয়, ক্রিকেটের সবচেয়ে পুরনো সংস্করণ- টেস্টেও তিনি সমান কার্যকরী। গত বছর ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি দুই ফরম্যাটেই অভিষেক হয়েছে। দুই ফরম্যাটেই পেয়েছেন সেঞ্চুরি। এবার ডাবল সেঞ্চুরি তুলে নিলেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বিশাখাপত্তনম টেস্টের দ্বিতীয় দিনে টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম দ্বিশতক পূরণ করেছেন তিনি। একটুর জন্য কনিষ্ঠতম ভারতীয় হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ডটা নিজের করে নিতে পারেননি জয়সওয়াল। টেস্টে সবচেয়ে কম বয়সী ভারতীয় হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড বিনোদ কাম্বলির। ১৯৯৩ সালে ওয়াংখেড়েতে এই ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই তিনি ২১ বছর ৩২ দিন বয়সে দ্বিশতরান পূরণ করেছিলেন। ভেঙেছিলেন ১৯৭১ সালে গড়া সুনীল গাভাস্কারের রেকর্ড। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পোর্ট অব স্পেনে ২১ বছর ২৭৭ দিন বয়সে প্রথম ডাবল সেঞ্চুর পেয়েছিলেন ভারতীয় কিংবদন্তি। তাদের পর ২২ বছর ৩৭ দিন বয়সে তৃতীয় কনিষ্ঠ ভারতীয় হিসেবে ২০০ ছাড়ানো ইনিংস খেললেন জয়সওয়াল। সব মিলিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে কনিষ্ঠতম ডাবল সেঞ্চুরিয়ান পাকিস্তানের জাভেদ মিয়াঁদাদ। ১৯৭৬ সালে নিউজ়িল্যান্ডের বিপক্ষে যখন দ্বিশতক পেয়েছিলেন, তখন পাকিস্তানি ব্যাটারের বয়স ছিল ১৯ বছর ১৪০ দিন। গত ২০ বছরে জয়সওয়ারের চেয়ে কম বয়সে ডাবল সেঞ্চুরি পেয়েছেন মাত্র একজন। ২০১৪ সালে ২১ বছর ২৭৮ দিন বয়সে বাংলাদেশের বিপক্ষে কীর্তি গড়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রেগ ব্র্যাথওয়েট। এই রেকর্ডটির দিকে তাকিয়ে একটা বিষয় বলাই যায়, গত ২০ বছরে টেস্ট ক্রিকেটের মঞ্চে অল্প বয়সে জয়সওয়ালের মতো প্রতিভার ঝলক দেখাতে পারেননি আর কেউ। মাত্র ২২ বছর বয়সে ভারতীয় দলের ওপেনারের ভ‚মিকায় নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে নিলেন জয়সওয়াল। বয়সের দিকে তাকালে তার ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায়- এলেন, খেললেন, জয় করলেন। সত্যি তাই। কিন্তু এই অবস্থায় আসতে কম কাঠখর পোড়াতে হয়নি তাকে। জীবনযুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। ক্ষুধার জ¦ালায় যেমন কষ্ট করেছেন, তেমনি আবাস্থনের অভাবে রাত্রিযাপন করতে হয়েছে গোয়ালঘরে! এমনকি পানিপুরি বিক্রি করে জীবনধারণের পথ বেছে নিতে হয়েছিল আজকের জয়সওয়ালকে। গতবারের আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিপক্ষে মাত্র ১৩ বলে ফিফটি করেছিলেন জয়সওয়াল। আইপিএল ইতিহাসের দ্রæততম ফিফটি নিজের করে নেন রাজস্থান রয়্যালসের ওপেনার। তার রানবন্যা দেখে বিরাট কোহলি-রোহিত শর্মা প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রোহিত বলেছিলেন, ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন আবিষ্কার জয়সওয়াল। এবার জাতীয় দলের জার্সিতে আলো ছড়িয়ে হয়ে উঠেছেন ভারতীয় ক্রিকেটের ‘নতুন পোস্টার’। কিন্তু যে পথে হেঁটে জয়সওয়াল আজকের অবস্থানে, সেটি সবার জন্য হতে পারে অনুপ্রেরণা। সেই ১১ বছর বয়স থেকে শুরু তার সংগ্রাম। জন্ম তার উত্তর প্রদেশে, তবে বেড়ে ওঠা মুম্বাইয়ে। এই শহরে টিকে থাকতে কতই-না পরীক্ষার সামনে পড়তে হয়েছে তাকে। তবু আঁকড়ে ধরে ছিলেন। মুম্বাইয়ে এসেছিলেন ক্রিকেট ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন নিয়ে। উঠেছিলেন এক চাচার বাসায়। থাকার জায়গা যেহেতু আছে, মনোযোগ দিতে হবে শুধু খেলায়! কিন্তু কয়েকদিন না যেতেই সম্মুখীন হলেন নিষ্ঠুর বাস্তবতার। চাচার বাসায় ঘর মাত্র দুটি। লোকসংখ্যা বেশি থাকায় জয়সওয়ালের জায়গা নেই। ফলে তার শোবার জায়গা হলো গোয়ালঘর! ক্রিকেটার হওয়ার বড় স্বপ্ন দেখা জয়সওয়াল তাতেই খুশি, বিশাল মুম্বাই শহরে তবু তো একটা থাকার জায়গা আছে। কিন্তু কয়েকদিন পর সে জায়গাও আর থাকলো না। চাচা জানিয়ে দিলেন, এখানে থাকা যাবে না, অন্যত্র ব্যবস্থা করতে হবে! অবশ্য তার চাচা একেবারে হাত ছেড়ে দিয়েছিলেন, ব্যাপারটা অমন নয়। তিনি ছিলেন মুম্বাইয়ের মুসলিম ইউনাইটেড ক্লাবের ম্যানেজার। ক্লাব কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন জয়সওয়ালের থাকার জায়গা করে দেওয়ার। ক্লাবের মাঠ আজাদ ময়দানে গ্রাউন্ডসম্যানরা থাকতেন তাঁবুতে, সেখানে থাকার অনুমতি মেলে জয়সওয়ালের। ওই তাঁবুতে তিন বছর ঘরবাড়ি ছিল তার। থাকার না হয় একটা বন্দোবস্ত হলো, কিন্তু খাবেন কী? টাকা-পয়সাও সেভাবে কাছে নেই। ফলে অনেক রাত তিনি কাটিয়েছে না খেয়ে। ক্ষুধার্ত পেট নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু এভাবে কতদিন! তখনই খেয়াল করলেন, আজাদ ময়দানের সামনে অনেকেই পানিপুরি বিক্রি করেন। জয়সওয়াল ভাবলেন, পানিপুনি বিক্রি করলে মন্দ হয় না। তাতে ক্রিকেটের বাইরের সময়টাও কাটবে, টাকাও আসবে। সেই ভাবনা থেকেই দিনে চললো তার ক্রিকেট শিক্ষা, আর রাতে আজাদ ময়দানের সামনে পানিপুরি বিক্রি। ক্রিকেট শুরুর দিনগুলোতে কষ্ট করে জীবনধারণ করা জয়সওয়াল হয়তো ঝরেই পড়তেন পানিপুরি বিক্রি করে। সেটি হয়নি কারণ তার জীবনে আসেন কোচ জাওলা সিং। মুম্বাইয়ের এই কোচের হাত ধরেই ক্রিকেটে চলার পথটা তৈরি হয় তার। রাস্তা থেকে জয়সওয়ালকে বাড়িতে তোলেন তিনি। মুম্বাইয়ে অভিভাবক পেয়ে যান এই ক্রিকেটার। পরের সময়টা শুধুই এগিয়ে যাওয়ার। জয়সওয়াল প্রথমবার প্রচারের আলোয় আসেন ২০১৫ সালের স্কুল ক্রিকেটে। সে বছর গিলস শিল্ডের ম্যাচে খেলেছিলেন ৩১৯ রানের অপরাজিত ইনিংস। ‘লম্বা রেসের ঘোড়া’ জয়সওয়াল সুযোগ পেলে যান মুম্বাইয়ের অনূর্ধ্ব-১৬ দলে। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে আলো ছড়িয়ে জায়গা পান ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও। ২০২০ যুব বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও এই ক্রিকেটার। এরপর আইপিএলে সুযোগ এবং রাতারাতি নাম ছড়িয়ে পড়া। তারপরও দেখার ছিল জাতীয় দলের ক্যারিয়ার। ভারতীয় কত ক্রিকেটারই তো আছেন, যারা ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করলেও জাতীয় দলে ব্যর্থ হয়েছেন। জয়সওয়াল সেই দলের নন। যার সবশেষ প্রমাণ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি।
https://www.kaabait.com