আওরঙ্গজেব কামাল : রাজনীতিবীদ ও ভিন্ন পেশাজীবীরা সাংবাদিকতায় অনুপ্রবেশ করায় সাংবাদিকতা হুমকীর মুখে পড়েছে। এক শ্রেনীর খারাপ লোক এই পেশাকে বিতর্কিত করছে। আর এ বিষয়ে প্রশাসনিক তদারকি করা একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে অনেক ভেবে দেখেছি রাজনীতীবিদরা বা ভিন্ন পেশাজীবীরা যখন সাংবাদিক হয়ে যায় তখন সাংবাদিকতার মান কমে যায় এবং সাংবাদিকদের নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হয়। ফলে রাষ্ট্র ও জনগন সমান ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে, একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে একজন সাংবাদিকের ভূমিকা কী হবে এবং কে সাংবাদিক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন – এমন প্রশ্ন আমরা সামনে আনি না কখনও, আলোচনাও করি না। পরাধীন রাষ্ট্রের সাংবাদিকতার সঙ্গে স্বাধীন রাষ্ট্রের সাংবাদিকতাকে আমরা গুলিয়ে ফেলছি। গণতান্ত্রিক সমাজে সাংবাদিকেরা জাতীয় ইস্যুগুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরবেন, সে বিষয়ে বিতর্ক করবেন, যাতে পাঠক তথা জনগণের সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়। অর্থাৎ নির্দিষ্ট ইস্যুতে পাঠক কে শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব সাংবাদিকরা নিবেন। আর রাজনীতিবিদেরা তাদের ভোটারদের, মানে নির্বাচকদের জন্য যেটা ভালো হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেবেন। অর্থাৎ একজন সাংবাদিক জনগণের পক্ষে এমনভাবে কাজ করবেন, যাতে রাজনীতিবিদেরা তাদের দেওয়া অঙ্গীকার গুলো সুচারুভাবে বাস্তবায়ন করে যেতে পারেন। অর্থাৎ জনগণের হয়ে ওকালতির কাজটা করে যাবেন সাংবাদিকেরা। রাজনীতিবিদেরা জনগণের হয়ে জনগণের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেবেন আর সাংবাদিকেরা সেখানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবেন। সাংবাদিক আর রাজনীতিবিদের এই সম্পর্ক একটি সুন্দর সমাজ গঠনে ভুমিকা রাখতে পারে। কিন্ত যদি রাজনীতিবিদেরা সাংবাদিক হয়ে যায় তাহলে জনগণের পক্ষে ওকালাতি করার কেহ থাকে না। ফলে অপরাধ বৈধতা পায়। আমার মতে একজন রাজনীতিবিদ যেমন একইসাথে সাংবাদিক হবেন না, তেমনি একজন সাংবাদিকও একইসাথে রাজনীতিবিদ হবেন না। সাংবাদিকের কাজ আর দলীয় মুখপাত্রের কাজের তফাৎ টানতে হলে এই সিদ্ধান্তে আসতেই হবে। একইসাথে সাংবাদিকতা ও রাজনীতি না করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে সেটা হবে মৌলিক অধিকার পরিপন্থি। ব্যক্তি সার্বভৌম। তিনিই সিদ্ধান্ত নিবেন তার পেশা কী হবে। কিন্তু নেশা কী করবেন, সেই সিদ্ধান্ত কি নিতে পারেন? পারেন না। তাকে আইন-কানুন বিধিবিধান মেনে চলতে হয়। তেমনি সাংবাদিকদের কিছু আচরণবিধি মেনে চলতে হবে। আমাদের দেশের বর্তমান যে কোন দলের বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা হতে চাইলে সর্বপ্রথম যেটা দরকার তা হল সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দেওয়া। একটু ভেবে দেখুন তারা বাংলাদেশে রাজনীতি করবে আবার সাংবাদিকতা ও করবে এর ফলে তাদের বিরুদ্ধে কোন কিছু বলা হলে তখন তারা সমগ্র সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করে। তারা কোন সময় বলে না তারা একজন রাজনীতিবীদ বরং তারা সব সময় রাজনৈতিক ফয়দা লাভ করে যাচ্ছে। অথচ নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সকল সুবিধা ভোগ করছে। এই সাংবাদিকরা যখন তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ব্যবহার করে দলীয় মতামত সাংবাদিকতার মাধ্যেমে প্রকাশ করে তখন আর তাদের কাছে কোন প্রকার অপেশা দায়িত্ব বোধ হয়না কিন্তু যখন কোন দল এর ফলে কোন প্রকার প্রতিরোধ বা প্রদিবাদ জানায় তখন তারা তাদের কে সাংবাদিক হিসাবে জাহির করে। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির সাংবাদিকতা তাতে অবশ্যই ব্যঘাত ঘটাবে। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা, একটি গণতান্ত্রিক দেশের মহা গুরুত্বপূর্ণ উপযোগ৷কিন্ত বর্তমান পরিস্থিতি দেখলে হয়তো আর বলার মত কিছু নেই।আমরা সাংবাদিকেরাই বা কতটা নিরপেক্ষ হতে পারছি ৷ নাকি দল কানা হয়ে নিজের পকেট ভারী করার ধান্দায় আছি৷ সেটা কারো অজানা নয়।ছোট এই বাংলাদেশে সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমের অভাব নেই৷ তথ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিবন্ধিত পত্রপত্রিকার সংখ্যাই ৩২১০ টি (অনলাইন গণমাধ্যম ব্যতীত) যার মধ্যে ১৩৫৭ টি ঢাকা থেকে এবং ১৮৫৩ টি অন্যান্য জেলা থেকে প্রকাশিত হয়৷ তার উপর আছে বেসরকারি টেলিভিশ চ্যানেল ও অনলাইন সংবাদ মাধ্যম৷ এগুলোর সংখ্যার হিসাবে আর না যাই৷ এই সব কর্মরত পত্রপত্রিকার বা মিডিয়ার সাংবাদিকরা ঠিকমত বেতন ভাতা পায় না ধান্ধামি করে চলতে হয়।এটার দেখার দায়ীত্ব কার। প্রতিদিন পত্রিকা খুললে দেখা যায় ভূয়া সাংবাদিক গ্রেফতার,চাঁদাবাজী করতে যেয়ে সাংবাদিক গ্রেফতারসহ নানা বিধ সংবাদ প্রচারিত হয়। আসলে কেন এম হচ্ছে, তার মুল কারন কি, কেহ একবার ভেবে দেখেছেন? প্রথম কারন রাজনৈতিক পেশী শক্তির প্রভাব,রাজনৈতিক সাংবাদিকতা,অদক্ষ ব্যাক্তি সাংবাদিক,ভিন্ন পেশার লোকোর সাংবাদিকতা দখল,স্বল্প শিক্ষিত ব্যাক্তি সাংবাদিক হওয়া এবং অপরাধীরা অর্থের বিনিময়ে সাংবাদিকতায় এসে এই পেশাকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা। যে কারনে দিন দিন বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও সংবাদমাধ্যমের অবস্থা করুণ থেকে করুণতর হচ্ছে৷ ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সও একই কথা বলছে৷ এক কথায় কোনো সংবাদ সেটা যত বস্তুনিষ্ঠ হোক না কেন তা রাজনীতির বা প্রশাসনের বিপক্ষে গেলে নানা মুখি চাপ আসতে শুরু করে৷সংবাদকর্মীরা ব্যক্তিগতভাবেও হুমকির শিকার হন৷ শারীরিকভাবে নিপীড়ন বা সামাজিকভাবে হেনেস্তার শিকার হতে হয়৷ কখনো কখনো সেটা এতটাই প্রকট যে প্রাণনাশের ঝুঁকিতেও পড়তে হয়৷ এক্ষেত্রে মফস্বল সাংবাদিকেরা অনেক বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন৷ দেখা যায় ঝুঁকির কারণে ভয়ে সাংবাদিকরা খবর প্রকাশ করেন না৷ আবার যদিও বা করেন সেটাতে নাম না দেওয়া বা খবরটি তুলে নেওয়াসহ নানা অনুরোধ আসতে থাকে৷ এরকম অসংখ্য ঘটনা আমার সামনে ঘটেছে। এসব নানাবিধ কারনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কড়া সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে প্রকৃত সাংবাদিকদের। অবশ্যই আমি রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে বলছি না আমি বলছি সাংবাদিকরা শুধু সাংবাদিকতা করবে আর যে যার পেশায় কাজ করবে তা হলে হয়তো সাংবাদিকতায় সমস্যা কম হবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে অনেক সাংবাদিক প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এ জন্য তারা কারাবরণও করেছেন। ইত্তেফাক-এর তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, দ্য বাংলাদেশ অবজারভার-এর আব্দুস সালাম, সংবাদ-এর জহুর হোসেন চৌধুরী শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামই করেননি, জাতি গঠনেও ভূমিকা রেখেছেন। পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠির আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে তারা লড়ে গেছেন। পাকিস্তান আমলে যেভাবে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন সাংবাদিকেরা, তেমনি স্বাধীন দেশে স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামেও তারা ভূমিকা রেখেছেন। কিন্ত এখন সমস্য কোথায় ? কারন তাদের মতাদর্শের সাথে বর্তমান ভীন্নরুপ। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে এখন আমরা দেখতে পাই, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি হয়ে গেছে ব্যক্তিগত সুবিধা আদায় বা বাড়তি অর্থযোগের মাধ্যম। বিশেষ করে সামরিক শাসন পরবর্তী সময়ে বা নব্বই পরবর্তী ‘গণতান্ত্রিক’ আমলে আমরা সাংবাদিকদের দেখতে পাই ভিন্ন এক রূপে। আগে কেউ কেউ পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত থাকলেও এখন সেটা হয়ে গেছে প্রত্যক্ষ সংযোগ। বিশেষ করে সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের সংগঠন রাজনৈতিক মতাদর্শের আলোকে বিভক্ত হয়ে আলাদা আলাদাভাবে কার্যক্রম চালানোর পর সাংবাদিক নেতারা ‘বস্তুনিষ্ঠ’ থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলেছেন। বর্তমানে সাংবাদিকতায় অনুপ্রবেশের ঘটনা নজরে আসার মত। যে কোনো অনুপ্রবেশকেই দেখা হয় নেতিবাচক দৃষ্টিতে। কখনো কখনো অনুপ্রবেশ মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, ভীতিও সঞ্চার করে। লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় অনুপ্রবেশকারীর আধিক্য এখন সবচেয়ে বেশি। সমাজে আরেক শ্রেণির সাংবাদিক রয়েছেন ‘সাংবাদিকতা সাইন বোডর্’ গায়ে ঝুলিয়ে দালালী, চাটুকারিতা আর ধান্ধাবাজির মাধ্যমে নিজের নিজের আখের গোছাতে সবর্দা ব্যস্ত। কেউ কেউ রাতারাতি বাড়ি ও একাধিক গাড়িও করে ফেলেছেন। আবার ভিন্ন চিত্রও চোখে পড়ে। অভাবের তাড়নায় অনেকে ধুঁকে ধুঁকে মরেছেন। অনুপ্রবেশকারী সাংবাদিকরা পোয়াবারো। এটা ঠেকানোর উপায় কী। এ ব্যাপারে তদারকি প্রতিষ্ঠানের জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। এই দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকেই। অন্যদিকে সংবাদপত্র, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা বিষয়ে দেশের অধিকাংশ মানুষেরই স্বচ্ছ ধারণা নেই। সাংবাদিকদের পেশাগত যোগ্যতা সম্পকের্ও অনেকেই ওয়াকিবহাল নয়। এই পেশাকে ভাঙিয়ে খাচ্ছেন দেশের হাজার হাজার মানুষ। প্রতারণার মাধ্যমে ভয় দেখিয়ে কেউ কেউ রাতারাতি ফ্ল্যাট গাড়ি করে ফেলেছে, কামিয়েছে কোটি কোটি টাকা।