সাতক্ষীরার শ্যামনগরে দেড় হাজার টাকার পানির ট্যাঙ্ক বিক্রি করেছে ১৫ হাজার টাকায়, গরিবরা পায়নি সরকারি ট্যাংক । সুপেয় পানিসহ দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারযোগ্য পানির সংকট নতুন কিছু নয়। এই সংকট নিরসনে সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও তার সুফল পাচ্ছে না প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে একাধিক প্রকল্প শুধু টাকা খরচের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই থেকে যাচ্ছে সংকট। শ্যামনগর উপকূলীয় এলাকায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে পানি সংরক্ষণের ট্যাংক ও অন্যান্য সরঞ্জাম দেওয়া হচ্ছে। ‘সমগ্র দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প’ ও ‘উপকূলীয় জেলাসমূহে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ’ নামে দুটি প্রকল্পের আওতায় এই কাজ হচ্ছে।
বাড়িতে তিন হাজার লিটার বৃষ্টির পানি ধারণক্ষমতার পানির ট্যাংক ও অন্যান্য সরঞ্জাম স্থাপনের জন্য উপকারভোগীদের ১ হাজার ৫০০ টাকা হারে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়। কিন্তু শ্যামনগরে এজন্য গুনতে হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত, যা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও ঠিকাদার ও তার লোকজন নিচ্ছেন বলে অভিযোগ।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, খাবার পানির সংকটে থাকা প্রকৃত অসহায় দরিদ্র মানুষের পরিবর্তে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিত্তবান ও চাকরিজীবীদের মাঝে অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে পানির ট্যাংক বিতরণ করা হয়েছে। কারণ তিন হাজার লিটারের একটি পানির ট্যাংক দোকানে কিনতে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা লাগে। কিন্তু এখানে তারা ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় পাচ্ছেন। যদিও ট্যাংকে লেখা আছে ‘জলধারাটি ক্রয় ও বিক্রয় সমভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ’।
বঙ্গোপসাগরের সন্নিকটে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরার সর্বশেষ উপজেলা শ্যামনগর। সমুদ্রঘেঁষা হওয়ায় এ উপজেলার অধিকাংশ এলাকার পানি লবণাক্ত। তাই বসানো যায় না গভীর নলকূপ। বর্ষাকালে পানিতে লবণাক্ততা কম থাকলেও শুকনো মৌসুমে মানুষকে গুরুতর দুর্ভোগ পোহাতে হয়। দৈনন্দিন কাজকর্ম সারতে ও পান করতে তখন একমাত্র অবলম্বন পুকুর ও ধরে রাখা বৃষ্টির পানি। অথচ সেই পানির কষ্টে থাকা উপকূলের অসহায় মানুষ পাচ্ছে না সরকারের এই সুবিধা।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, দেড়-দুই বছর আগে পানির ট্যাংক বাবদ টাকা জমা দিলেও তারা এখনও পাননি। অথচ যারা ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে দিচ্ছে তাদের বাড়িতে পানির ট্যাংক পৌঁছে যাচ্ছে।
কৈখালী ইউনিয়নের শৈলখালী এলাকায় গেলে অনুসন্ধানে গেলে আয়েশা খাতুন নামের এক বৃদ্ধ বলেন, দিনে দুই-তিনবার অনেক দূর হেঁটে পানি আনতে হয়। মাজায় আর সয় না। পাত্র না থাকায় বৃষ্টির সময় পানি ধরে রাখতে পারি না। শুনেছি সরকার থেকে তিন হাজার লিটারের পানির ট্যাংক দিচ্ছে। অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি, কিন্তু কেউ দেইনি। পাশের বাড়ির ওরা ১৩ হাজার টাকা দিয়ে একটা কিনেছে। সরকার যদি আমার একটা পানির ট্যাংক দিত তাহলে আমার কষ্ট অনেকটা কমত।
একই আক্ষেপ বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের আবাদচণ্ডিপুর বনবিতলা এলাকার এরশাদ আলী মির্জার। তিনি বলেন, ‘সরকার সস্তায় পানির ড্রাম দেচ্ছে শুনে আমি পাবলিক হেলথ অফিসে কাজ করা হাওলভাঙ্গী এলাকার হামিদের মাধ্যমে ১২ হাজার টাকা দিয়ে একটা ড্রাম কিনিছি। শুধু আমি না, আমার এলাকার আরও ছয়-সাতজন কিনেছে। সবার কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা করে নেছে।’
রমজাননগর ইউনিয়নের পাতড়াখোলা এলাকার আল মামুন বলেন, ‘একজনের (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) মাধ্যম দিয়ে আমিসহ আরও ৫ জন প্রতিটি ৮ হাজার টাকা দরে পানির ট্যাংক ক্রয় করেছি। সেই পানির ট্যাংক শ্যামনগরের চণ্ডিপুর থেকে ঠিকাদার নজরুল ইসলাম আমাদের দেয়।’ ট্যাংকের অন্যান্য সরঞ্জামসহ গোড়া পাকা (বাড়িতে স্থাপন) করা হয়েছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ট্যাংক নেওয়ার সময় বলে দিয়েছে আপনারা তালিকার বাইরে। আপনাদের ট্যাংকের অন্যান্য সরঞ্জাম ও গোড়া পাকা হবে না।’
যথারীতি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘সাবেক সংসদ সদস্য ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে যে তালিকা পাওয়া গেছে সেই তালিকা অনুযায়ী ট্যাংক বিতরণ করা হয়েছে কোনোরকম দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই।