ইমদাদুল হক, পাইকগাছা (খুলনা): ১ এপ্রিল থেকে সুন্দরবনে শুরু হয়েছে মধু আহরণ মৌসুম। নৌকা মেরামত, মহাজনের কাছ থেকে দাদন নেওয়াসহ সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে বনে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন মৌয়ালরা।
তবে প্রকৃতপক্ষে ১৫ মার্চ থেকে গোটা সুন্দরবনে মধু আহরণের মৌসুম শুরু হয়েছে। মৌসুম ১৫ দিন এগিয়ে আনলেও পূর্ব সুন্দরবন এলাকার মৌয়ালদের তাতে আগ্রহ নেই। কারণ এই আগাম সময়ে পূর্ব সুন্দরবনের গাছে ফুল ফোটে না। এই সময়টাতে পশ্চিম সুন্দরবনের গাছে আগাম ফুল চলে আসায় সাতক্ষীরা, কয়রা এলাকার মৌয়ালরা যান মধু সংগ্রহে। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বনের কোনো কোনো অংশের গাছে আগাম ফুল চলে আসে।এ কারণে তিন বছর ধরে আগাম আসা ফুলের মধুটা সংগ্রহের জন্যই এই সিদ্ধান্ত নেয় বন বিভাগ।
পূর্ব বন বিভাগ থেকে জানা গেছে, এ বছর ৬০০ কুইন্টাল মধু এবং ২০০ কুইন্টাল মোম আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। মধু সংগ্রহের নিয়ম এবং বন আইনের নীতিমালা অনুসরণ করে ১ এপ্রিল থেকেই মৌয়ালদের পাস (অনুমতিপত্র) দেওয়া শুরু হবে। পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) শেখ মাহাবুব হাসান বলেন, ১৫ মার্চ থেকেই মূলত মধু আহরণের মৌসুম শুরু হয়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে পূর্ব সুন্দরবনের গাছে ফুল একটু দেরিতে আসে।তাই ১ এপ্রিল থেকেই বনে যাবেন মৌয়ালরা।
এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সুন্দরবনে মধু আহরণের মৌসুম। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ২০২২ সাল থেকে এপ্রিল ও মে মাসে মধু সংগ্রহের জন্য মৌয়ালদের পাস-পারমিট দিয়ে আসছে বন বিভাগ। এ জন্য সাতক্ষীরা পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগের বিভিন্ন রেঞ্জের স্টেশন অফিসগুলোতে ১ এপ্রিল থেকে পাস-পারমিট দেওয়া শুরু হয়েছে।
মৌয়ালদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৌসুমের শুরুতে খলিশা ফুলে মধু আসে। এরপর আসে গারণ ফুলের মধু। শেষে আসে কেওড়া ও ছইলা ফুলের মধু। এই তিন প্রজাতির মধুর মধ্যে সবচেয়ে দামি হচ্ছে খলিশার মধু। এ বছর এই অঞ্চলে সে রকম বৃষ্টি হয়নি। বৃষ্টি না হওয়ায় ফুল শুকিয়ে ঝরে যায়, তাই মধু জমে কম। তার ওপর মধু চোর চক্রের উপদ্রব তো রয়েছেই। এ জন্য এই বছর মধু কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী রেঞ্জ কর্মকর্তা নূরুল আলম বলেন, চলতি মৌসুমে ১ হাজার ৫০০ কুইন্টাল মধু এবং ৪৫০ কুইন্টাল মোম পাওয়ার আশা করছে বন বিভাগ। যারা পাস-পারমিট নিয়ে বনে যাবেন, তাদের প্রতিটি নৌকায় সর্বোচ্চ ১০ জন মৌয়াল অবস্থান করতে পারবেন। একজন মৌয়াল ১৫ দিনের জন্য সর্বোচ্চ ৫০ কেজি মধু ও ১৫ কেজি মোম আহরণ করতে পারবেন। ১৫ দিনের বেশি কোনো মৌয়াল সুন্দরবনে অবস্থান করতে পারবেন না।
প্রতি বছর ১ এপ্রিল থেকে মধু আহরণ শুরু হয়। কিন্তু তার আগেই চুরি করে একাধিক চক্র মধু আহরণ করছে। মধু চোর প্রসঙ্গে বন কর্মকর্তা বলেন, সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরার পাস নিয়ে জেলেদের ছদ্মবেশে মধু চোর চক্র প্রবেশ করছে। মৌসুমের আগেই বনে ঢুকে চুরি করে তারা ৪০-৫০ শতাংশ মধু আহরণ করে ফেলছে। এর ফলে যে চাকে কমপক্ষে পাঁচ কেজি মধু পাওয়া যেত, এপ্রিলের আগে মধু আহরণ করলে ওই চাকে ৫০০ গ্রামের বেশি মধু পাওয়া যায় না। বন বিভাগে জনবলসংকটের কারণে চুরি ঠেকাতে পারছে না তারা।
সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগ থেকে এ বছর সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৮০০ কুইন্টাল মধু ও ১ হাজার ৫০ কুইন্টাল মোম পাওয়া যাবে বলে বনবিভাগ আশা করছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, সুন্দরবনে নির্বিঘ্নে মধু আহরণের জন্য বন বিভাগের টহল জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া এবার বন্যপ্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য গ্রুপের একজন মৌয়ালকে সবসময় চারিদিকে খেয়াল রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি মৌচাকের কিছু অংশ রেখে কাটতে বলা হয়েছে। মৌচাকের যে স্থানে ডিম থাকে সেখান থেকে কিছুটা রেখে বাকী অংশ কাটলে মৌমাছি বাড়বে ও মৌচাকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে।আর মৌয়ালরা মধুও বেশি পাবে।