সাতক্ষীরার অন্যতম জনপ্রিয় সুস্বাদু কুমড়োর বড়ির সারাদেশসহ বিদেশেও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সহজলভ্য উপাদান দিয়ে তৈরি হওয়া কুমড়োর বড়ির চাহিদা দিনদিন ব্যাপক বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা, যথাযথ পরিবেশ আর বাজার সৃষ্টি করতে পারলে কুমড়োর বড়ি খুলে দিতে পারে অর্থনৈতিক সাফল্যের নতুন দিগন্ত। কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ঘুরে যেতে পারে সাতক্ষীরার অর্থনীতির চাকা। সেজন্য দরকার সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে এগিয়ে আসা।
সারাদেশের ন্যায় সাতক্ষীরাতেও বেশ কয়েকদিন ধরে শীতের হাওয়া বইতে শুরু হয়েছে। আর শুরু থেকেই সাতক্ষীরার গ্রামাঞ্চলে শুরু হয়েছে কুমড়োর বড়ি তৈরির মহোৎসব। পাকা চালকুমড়া আর মাশকালাই ডাল ও পরিমাণ মতো লবনের মিশ্রণে তৈরি এই বড়ি এখন শুধু খাবার নয়, বরং অনেক পরিবারের আয়ের অন্যতম উৎস। গ্রামের নারীরা ঘরে ঘরে বসে ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে শিল-পাটায় ডাল বাটা, কুমড়া কুচি করা, তারপর হাতে বড়ি তৈরি করে রোদে শুকাচ্ছেন। আবার অনেকে কাকডাকা ভোরে আগের দিন প্রস্তুত করে রাখা ডাল ও কুমড়ো মিল থেকে পিষে এনে নিপুণ হাতের দক্ষ কৌশলে শৈল্পিক ছোঁয়ায় সুস্বাদু কুমড়োর বড়ি তৈরি করেছেন।
এবারের শীতে অন্যান্য বছরের তুলনায় কুমড়োর বড়ির চাহিদা বহুগুণ বেড়েছে। সাতক্ষীরার বিভিন্ন বাজারে কেজি প্রতি দাম ৩৫০-৪০০ টাকা, যা শহুরে বাজারে আরও বেশি হওয়ার সম্ভবনা আছে। সাতক্ষীরার প্রতিটি গ্রামে কাকডাকা ভোরে শুরু হয় গৃহিনীদের এই কর্মযজ্ঞ।
সরেজমিনে সদরের ফিংড়ী, ফয়জুল্যাপুর, ব্রহ্মরাজপুর,, বড়খামার, কালেরডাঙা, নুনগোলা, ধুলিহর,বালুইগাছা, কোমরপুর,চাঁদপুর, বুধহাটাসহ বিভিন্ন এলাকার গ্রামগুলোতে গিয়ে এই বড়ি তৈরির কাজ সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে জেলার কলারোয়া, তালা, পাটকেলঘাটা, দেবহাটা, কালীগঞ্জ, আশাশুনী ও শ্যামনগর উপজেলার প্রতিটি গ্রামে এ দৃশ্য এখন চোখে পড়ার মতো।
স্থানীয় ফয়জুল্যাপুর গ্রামের ফিরোজা বেগম নামের একজন গৃহবধূ জানিয়েছেন, আমরা প্রতি বছর শীতকালে কুমড়োর বড়ি তৈরি করি। সারা বছর সংরক্ষণ করে বিভিন্ন তরকারি দিয়ে রান্না করা হয়। এতে তরকারির স্বাদ বহুগুণে বেড়ে যায়। ছোট-বড় সকলের পছন্দের খাবার হচ্ছে কুমড়োর বড়ি। অত্যন্ত সুস্বাদু ও মজাদার হওয়ায় পরিবারের সবাই খেতে খুব পছন্দ করে। তাছাড়া অনেকেই এটি তৈরি করে বিক্রি করে থাকেন। সারাদেশে দিনদিন এর ব্যাপক চাহিদা বাড়ছে। এছাড়া দেশের গন্ডি পেরিয়ে এখন কুমড়োর বড়ি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
আরেক গৃহবধু সাদিয়া খাতুন এ প্রতিনিধিকে বলেন- কুমড়োর বড়ি তৈরির উপকরণ সহজলভ্য হওয়ায় বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় সুস্বাদু এই খাবারটির চাহিদা দিনদিন বেশ বাড়ছে। এটি তৈরি করতে প্রথমে পাকা চালকুমড়া ভালো করে ধুয়ে ছোট ছোট টুকরো করা হয়। এরপর মাশকালাই ডাল সারারাত ভিজিয়ে রেখে শিল-পাটায় বেটে নিতে হয়। কুমড়ার টুকরোগুলোও বেটে নেয়া হয়। দুই উপাদান মিশিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে ঘন পেস্ট তৈরি করে শৈল্পিক হাতের ছোঁয়ায় ছোট ছোট বড়ি দেওয়া হয়। তারপর রোদে শুকাতে দেওয়া হয়। শুকানোর পর বড়িগুলো কাচের বয়াম বা বায়ুরোধী প্যাকেটে ভরে খুব সহজে সারাবছর সংরক্ষণ করা যায়। অনেকে এটি তৈরি করে বিক্রি করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছেন।
তিনি আরও বলেন উপযুক্ত পরিবেশ আর পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এতে অর্থনীতির নতুন দিগন্ত খুলে যাবে।
সাতক্ষীরার গ্রামাঞ্চলে কুমড়োর বড়ি তৈরির দৃশ্য এখন শুধু ঐতিহ্য নয়, বরং অনেক পরিবারের জীবনধারার অংশ। একেকটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে ২ থেকে ৩ কেজি বড়ি তৈরি করতে পারে। উৎপাদন খরচের তুলনায় বাজারে দাম ভালো থাকায় আয়ও ভালো হবে। অনেক তরুণ-তরুণী এই কাজে যুক্ত হয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন। প্রতি কেজি উৎপাদন খরচ দু’শ থেকে আড়াইশ টাকা হলেও বিক্রি হয় তিন’শ থেকে চারশো টাকা।
কৃষক নিজাম সরদার বলেন, “আমাদের বাড়িতে চাল কুমড়া ভালো হয়। আগে এগুলো বিক্রি করতে পারতাম না। এখন বড়ি বানানোর জন্য বেশ ভালো দাম পাচ্ছি। সরকার যদি আরও প্রশিক্ষণ আর বাজার সুবিধা দেয়, তাহলে আরও বেশি মানুষ এই কাজে আসবে।”
সাতক্ষীরার উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, কুমড়োর বড়ি উৎপাদনকারী গ্রামগুলোতে প্রশিক্ষণ কর্মশালা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের সহজ ঋণ ও বাজার সৃষ্টির ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। আস্তে আস্তে এর পরিধি বৃদ্ধি করা হবে।
এভাবে শীতের আগমনে সাতক্ষীরার গ্রামগুলোতে এখন কুমড়োর বড়ি তৈরির কর্মযজ্ঞ দেখলে মনে হয় “যেন নতুন জীবনের উৎসবে মেতে ওঠার প্রতিযোগিতা চলছে আমাদের গৃহিনীদের”।
https://www.kaabait.com